রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০১:০৭ অপরাহ্ন

গাড়ি বন্ধ অফিস খোলা, চলছে বাড়ি ফেরাও

গাড়ি বন্ধ অফিস খোলা, চলছে বাড়ি ফেরাও

স্বদেশ ডেস্ক:

সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী গতকাল সোমবার সকাল থেকে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে সীমিত আকারে লকডাউন। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী রিকশা ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলার কথা নয়; কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে গতকাল সারাদিন রাজধানীজুড়ে ছিল যানজট। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও প্রাইভেটকার, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল চলেছে অহরহ। তিনগুণ ভাড়া গুনতে হয়েছে পথে বের হওয়া নগরবাসীকে। আবার ঢাকার প্রবেশপথগুলোতেও ছিল অসংখ্য মানুষের জটলা। পিকআপ, কাভার্ডভ্যান ও সিএনজি অটোরিকশায় মানুষ চলেছে দিনভর। সব মিলিয়ে, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সীমিত পরিসরে যান চলাচল স্রেফ কাগুজে হয়ে গেছে। বরং আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ঝুঁকিতেই অসংখ্য মানুষকে দেখা গেছে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করতে।

এদিকে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে গতকাল সকাল থেকে ফেরিতে দক্ষিণবঙ্গগামী যাত্রী পারাপারের চিত্রও দেখা গেছে। এ ছাড়া মাদারীপুরেও সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষিত হতে দেখা গেছে গতকাল। জেলার সড়কগুলোতে রিকশার পাশাপাশি মোটরসাইকেল, থ্রিহুইলার, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন যানবাহনকে দেখা গেছে যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে।

রাজধানীর গাবতলী, আমিনবাজার, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও পোস্তগোলার বাসস্ট্যান্ডগুলোতে গতকাল ছিল মানুষের প্রচুর ভিড়। যে যেভাবে পারছেন গাড়িতে উঠছেন। গতকাল সকালে সায়েদাবাদ থেকে মাইক্রোবাসে গাদাগাদি করে চাঁদপুরের কচুয়ায় রওনা হন মাহবুব নামে একজন। দেড়শ টাকার বাসভাড়ার স্থলে ৮০০ টাকা দিয়েছেন বলে জানান তিনি। তার মতে, কঠোর লকডাউনের কারণে আগেভাগেই বাড়ি যেতে হবে। তার কাছে অধিক ভাড়া কিংবা স্বাস্থ্যঝুঁকির চেয়েও জরুরি হচ্ছে বাড়ি ফেরা।

একই অবস্থা কল্যাণপুরের সাঈদের ক্ষেত্রেও। তার গ্রামের বাড়ি পাবনায়। গাবতলী থেকে হেঁটে তিনি আমিনবাজার ব্রিজ পার হচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলে জানালেন, বিকল্প ব্যবস্থায় কয়েক ধাপে যাবেন তিনি পাবনায়। সাঈদ বলেন, শহরে লকডাউনের কারণে কাজ নেই। তাই বাড়ি চলে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। তিনি বলেন, এ শহরে জীবিকার তাগিদে থাকি। সবকিছু বন্ধ থাকলে এখানে থাকার দরকার কী? উল্টো প্রশ্ন রাখেন তিনি।

গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর মতিঝিল, টিকাটুলী, দয়াগঞ্জ, গুলিস্তান, পুরানা পল্টন, কাকরাইল- এসব এলাকা ঘুরে নজরে পড়েনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো চেকপোস্ট। তবে বিকালের দিকে কিছু স্থানে চেকপোস্ট চোখে পড়ে। বলে রাখা ভালো, গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও খোলা আছে সরকারি-বেসরকারি অফিস। নিজেদের ব্যবস্থাপনায় অফিসগুলোকে তাদের কর্মী আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করতে নির্দেশনা দেওয়া হলেও অনেক প্রতিষ্ঠানই এমন ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে সকাল থেকে অফিসগামী মানুষের ভোগান্তি দেখা গেছে। বিকালে বাসায় ফিরতেও তাদের খুবই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

সোম, মঙ্গল ও বুধবার- এ তিন দিন সীমিত পরিসরের ‘লকডাউন’। গতকাল ছিল এর প্রথম দিন। এদিন শুধু পণ্যবাহী যানবাহন আর প্রধান সড়ক ছাড়া অন্যান্য সড়কে রিকশা চলাচলের অনুমতি থাকলেও রাজপথ দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গেছে ব্যক্তিগত যানবাহনকে। অনেকেই পিকআপ, ট্রাকে উঠে অফিসে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। রিকশাচালকদের এদিন দেখা গেছে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া হাঁকাতে। পাঠাও ও উবারের রাইড শেয়ারিংয়ের বাইক চালু থাকলেও চালকরা অ্যাপসের মাধ্যমে যাত্রী না টেনে চুক্তিতে বেশি দামে যাত্রী টেনেছেন। অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে অনেককেই দেখা গেছে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করতে।

বড় ও প্রধান সড়কের পাশের দোকানপাট বন্ধ থাকলেও পাড়া-মহল্লায় প্রায় সব ধরনের দোকানপাটই গতকাল খোলা দেখা গেছে। ছোট ছোট অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিরিয়ানি ও তেহারির দোকানে বসে খেতে দেখা গেছে খদ্দেরদের।

রাজধানীর মিরপুর, প্রগতি সরণি, এয়ারপোর্ট সড়কসহ বিভিন্ন এলাকার প্রধান সড়কগুলো ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে। যানবাহনের বেশিরভাগই ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রাইভেটকার, জিপ ইত্যাদি। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ব্যাংকসহ জরুরি যেসব অফিস খোলা, তাদের কর্মীরা পড়েছেন বিপাকে। দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়েও তারা পরিবহন পাননি। অনেকেই হেঁটে রওনা হয়েছেন গন্তব্যে। গণপরিবহনমুক্ত সড়কে রিকশার আধিপত্য থাকলেও পথে নামা বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য তা ছিল খুবই অপর্যাপ্ত। রিকশাচালকরাও ভাড়া হেঁকেছেন অনেক বেশি। অনেক রাস্তায় ভ্যানে করেও মানুষকে অফিসে যেতে দেখা গেছে। এর পাশাপাশি ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলে করেও অনেকে অফিসে গেছেন।

সিদ্ধেশ্বরীর বাসিন্দা হানিফ কাজ করেন গুলশানের একটি বেসরকারি সংস্থায়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা ভাড়ায়চালিত প্রাইভেটকারে অফিস করেন তিনি। খরচ গড়ে প্রতিদিন দেড়শ টাকা। তিনি বলেন, অফিস তো খোলা। সিএনজিতে করে দেড়শ টাকায় অফিসে চলে যেতাম। আজকে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে তার পর রিকশায় করে অফিসে গেছি ১৮০ টাকা ভাড়ায়। জানি না ফেরার সময় কী হবে! ভাড়া যে বেশি লাগছে তা-ই শুধু নয়, অফিসে যেতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে। নয়াপল্টন থেকে কাকরাইল মোড় পর্যন্ত টানা এক ঘণ্টা হাঁটার পর মিলেছে রিকশা। ভাড়াও গুনতে হয়েছে অনেক বেশি। এ টাকার জ্বালানি মোটরসাইকেলে ভরলে দুই-তিনদিন আরামে চলতে পারতাম।

যাত্রীদের বাড়তি ভাড়ার অভিযোগ মানতে নারাজ রিকশাওয়ালারা। তাদের বক্তব্য- নানা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তারা বাইরে বের হয়েছেন। যাত্রীরা যেখানে যেতে চাইছেন, সেখানেই পৌঁছে দিচ্ছেন। এ জন্য কিছুটা বাড়তি ভাড়া তো গুনতেই হবে।

মিরপুর এলাকার রিকশাচালক সিদ্দিক কাজীপাড়া থেকে মতিঝিলে দেড়শ টাকা ভাড়ায় এসেছেন। তিনি বলেন, সব বন্ধ থাকায় পাবলিক বিপদে পড়ছে। তাই ভাড়া বেশি নিছি। এ রকম সব রিকশাচালকই বাড়তি ভাড়ায় প্যাডেল চাপছেন শহরজুড়ে। মানুষ কীভাবে তার গন্তব্যে যাবে সে ব্যবস্থা নেই সংশ্লিষ্ট অফিস কর্তৃপক্ষের। তাই এক সপ্তাহের যাতায়াত খরচ একদিনে ঢেলে পথ চলতে হচ্ছে নগরবাসীর। আগামী ১ জুলাই থেকে আরও কঠোর লকডাউন হবে। বাড়ি থেকে মানুষ বের হতে পারবে না জরুরি প্রয়োজন ছাড়া। সেসব চিন্তা করে অনেকে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিচ্ছেন। কেউবা এ সুযোগে পথ ধরছেন গ্রামের বাড়ির। তাদের ধারণা, ঈদের আগে বাড়ি যাওয়ার এটাই সুযোগ!

শিমুলিয়ায় যাত্রী পারাপার অব্যাহত

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি নাদিম হোসাইন জানান, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া ঘাটে গতকাল সোমবার সকাল থেকে ফেরিতে দক্ষিণবঙ্গগামী অসংখ্য যাত্রী পারাপারের চিত্র লক্ষ করা গেছে। সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে রাজধানী ঢাকা থেকে ছোট ছোট যানবাহনে চড়ে ছুটে আসছেন তারা শিমুলিয়াঘাটে। গেল কয়েকদিনের তুলনায় গতকাল সকালে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপ বাড়তে থাকে। ঘাট এলাকায় গতকাল কয়েকশ যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে। এগুলোর মধ্যে পণ্যবোঝাই যান যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ব্যক্তিগত যানবাহনও। যদিও সকাল থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নজরদারি লক্ষ করা গেছে।

বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়াঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) ফয়সাল আহমেদ জানান, বর্তমানে দক্ষিণবঙ্গের এ নৌরুটে ১৪টি ফেরি চলাচল করছে। শিমুলিয়া ঘাটে ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে অন্তত ৫ শতাধিক যানবাহন। প্রতিটি ফেরিতে যানবাহনের সঙ্গে যাত্রী সাধারণও পাড়ি দিচ্ছেন। তিনি জানান, সিরিয়াল অনুযায়ী সব গাড়ি পার করা হবে।

লৌহজং থানার ওসি আলমগীর হোসেন বলেন, শিমুলিয়া মোড়ে চেকপোস্ট আছে, ঘাটের প্রবেশমুখেও চেকপোস্ট আছে। এ ছাড়া ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের শ্রীনগর এলাকায় চেকপোস্ট রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ও ডাক্তারি কাগজপত্র ছাড়া যাত্রীদের ঘাটে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল করছে। ঘাটেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) সুমন দেব জানান, শিমুলিয়া ঘাটের প্রবেশমুখে এবং ফেরির পন্টুনে দুটি চেকপোস্ট রয়েছে। যানবাহন যেন সারিবদ্ধভাবে ফেরিতে উঠতে পারে, সেজন্য এসব চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের নিমতলা চেকপোস্ট থেকে বিভিন্ন যানবাহন ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

মাদারীপুরে মাঠে নেই প্রশাসন

মাদারীপুর প্রতিনিধি শফিক স্বপন জানান, সরকারি প্রজ্ঞাপনে রিকশা, পণ্যবাহী ও জরুরি সেবায় যুক্ত যানবাহন ছাড়া সব ধরনের যান বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে; কিন্তু মাদারীপুরে মানা হচ্ছে না এ নির্দেশনা। নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠে দেখা যায়নি প্রশাসনকে। জেলার সড়কগুলোতে রিকশার পাশাপাশি মোটরসাইকেল, থ্রিহুইলার, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ছোট যানবাহন যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। সকালে শহর ঘুরে দেখা গেছে, মাঠে নামেনি পুলিশ বা প্রশাসন। মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও শহরের প্রধান সড়ক যান চলাচলের জন্য খোলা থাকলেও শহর ও গ্রামে প্রবেশ করার বেশিরভাগ সড়ক বাঁশ দিয়ে আটকে দিয়েছে প্রশাসন।

অপরদিকে গতকাল সকাল থেকে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে দক্ষিণাঞ্চলমুখী যাত্রীদের চাপ শুরু হয়। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে। দূরপাল্লার যান বন্ধ থাকায় গতকাল অনেককেই দেখা গেছে মোটরসাইকেল, থ্রিহুইলার, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন হালকা যানবাহনে ৩-৪ গুণ ভাড়া দিয়ে শিমুলিয়া ঘাটে আসতে। ফেরিতে গাদাগাদি করে তারা পদ্মা পাড়ি দিয়েছেন। বাংলাবাজার ঘাটে পৌঁছেও যাত্রীরা ফের ভোগান্তিতে পড়েন। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় বাংলাবাজার ঘাট থেকে ইজিবাইক, সিএনজি, মোটরসাইকেলে বরিশালে ৫০০-৬০০ টাকায়, গোপালগঞ্জে ৫০০ টাকায়, খুলনায় ৭০০ টাকায়, মাদারীপুরে ২০০ টাকায়, বাগেরহাটে ৬০০-৭০০ টাকায় যাত্রা করেন। গতকালও বরাবরের মতো ঘাট এলাকা বা ফেরিতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো লক্ষণই দেখা যায়নি যাত্রীদের মধ্যে। এ রুটে এদিন ১৬টি ফেরিতে যাত্রী ও যান পারাপার চলেছে।

বিআইডব্লিউটিসির কাঁঠালবাড়ী ঘাটের ম্যানেজার মো. সালাউদ্দিন মিয়া বলেন, পণ্যবাহী ট্রাকের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ব্যক্তিগত যানবাহনও চলাচল করছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877